• 23 Jan, 2025

জাতীয় ঐক্যের আহ্বান: স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় একমত দেশের সব রাজনৈতিক দল

জাতীয় ঐক্যের আহ্বান: স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় একমত দেশের সব রাজনৈতিক দল

দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। ভারতের উসকানি ও অপপ্রচারের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিয়ে জাতীয় স্বার্থে একসঙ্গে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তারা। সংলাপে ভারতের হস্তক্ষেপ, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের রোডম্যাপ নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

prothomalo-bangla_2024-12-04_sruii20k_8
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় শেষে ফটোসেশনে অংশ নেন। গতকাল ঢাকায় ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ছবি: সংগৃহীত

সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও দেশের স্বার্থে ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে এক ঐতিহাসিক বৈঠকে অংশ নিয়েছে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো। বুধবার বিকেলে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে দেশপ্রেম ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রশ্নে সবাই একমত হয়েছেন।

দেশের বিরুদ্ধে ভারতের অপপ্রচার, হস্তক্ষেপ ও সাম্প্রতিক উসকানিমূলক কর্মকাণ্ডের প্রেক্ষাপটে অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, সিপিবি, বাসদ, গণসংহতি আন্দোলন, ইসলামী আন্দোলন, নাগরিক ঐক্যসহ প্রায় ৩৫টি রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা অংশগ্রহণ করেন।

সংলাপের সূচনা বক্তব্য:
বৈঠকের শুরুতে ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও অস্তিত্ব রক্ষায় ঐক্যের গুরুত্ব তুলে ধরেন। তিনি বলেন, “আমরা যে স্বাধীনতা অর্জন করেছি, তা কোনো ভিন্নমতের ভিত্তিতে নয়; এটি ছিল আমাদের সম্মিলিত প্রয়াসের ফসল। আজও দেশের অস্তিত্বের প্রশ্নে আমাদের এক হতে হবে। সাম্প্রতিক ঘটনাবলি ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, আমাদের ঐক্য না থাকলে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়বে। রাজনৈতিক ভিন্নমত থাকুক, তবে দেশের প্রশ্নে সবাইকে একই কাতারে আসতে হবে।”

সংলাপের প্রেক্ষাপট:
এই সংলাপের আয়োজন মূলত সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের একাধিক উসকানিমূলক কর্মকাণ্ডের প্রেক্ষাপটে। আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে হামলা এবং জাতীয় পতাকা অবমাননার ঘটনা, ভারতের মিডিয়ায় বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার, এবং পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী পাঠানোর আহ্বানের মতো ঘটনাগুলো সংলাপের প্রাসঙ্গিকতা বাড়িয়েছে।

এছাড়াও, ৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ, সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেপ্তার ও এর জেরে এক আইনজীবীর হত্যার ঘটনাও বৈঠকে আলোচনার বিষয় ছিল।

বৈঠকের আলোচিত বিষয়গুলো:
বৈঠকে অংশ নেওয়া দলগুলোর নেতারা একাধিক প্রস্তাব উপস্থাপন করেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য—
১. ভারতের বাংলাদেশবিরোধী অপপ্রচার এবং উসকানির বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ।
২. জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমকে বাংলাদেশে আমন্ত্রণ জানিয়ে সত্য প্রকাশে উদ্যোগ নেওয়া।
৩. ৬৪ জেলায় সম্প্রীতি সমাবেশ আয়োজন করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অক্ষুণ্ণ রাখা।
৪. ভারতের সঙ্গে স্বাক্ষরিত সব চুক্তি জনসমক্ষে প্রকাশ এবং দেশের স্বার্থবিরোধী চুক্তি বাতিল।
৫. একটি অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় সরকার গঠন এবং দেশের সার্বিক স্থিতিশীলতার জন্য নির্বাচনের রোডম্যাপ প্রকাশ।

রাজনৈতিক নেতাদের বক্তব্য:
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, “দেশের স্বার্থে আমরা সরকারের সঙ্গে ঐকমত্য প্রকাশ করেছি। জনগণ যেভাবে ফ্যাসিস্ট সরকারকে বিদায় দিয়েছে, ঠিক সেভাবেই যেকোনো ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করব। আমাদের অবস্থান স্পষ্ট—স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে কোনো ছাড় নয়।”

জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান বলেন, “দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব আমাদের সবচেয়ে বড় সম্পদ। ভিন্নমত থাকলেও দেশের স্বার্থে সবাই একমত হয়েছি। প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্ব চাই, তবে সাম্প্রতিক উসকানিমূলক আচরণ কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যাবে না।”

গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, “দেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। সাম্প্রদায়িক উসকানির মোকাবিলায় সব ধর্মের মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। সত্য এবং ন্যায়ের মাধ্যমে এই অপপ্রচার রোধ করতে হবে।”

গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, “জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার মাধ্যমে একটি অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব এসেছে। আগামী দুই বছরের জন্য দেশের রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে।”

ভারতের কর্মকাণ্ডের তীব্র নিন্দা:
বৈঠকে ভারতের উসকানিমূলক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়। আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, “ভারত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করছে। এটি বন্ধ করার জন্য কূটনৈতিক উদ্যোগ জরুরি। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত হয়েছে যে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন এড়াতে তাদের বোঝাতে হবে—আমরা ভালো থাকলে তারাও ভালো থাকবে।”

জাতীয় ঐক্যের পথে অগ্রসর হওয়ার অঙ্গীকার:
এই বৈঠক দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বিরল ঐক্যের বার্তা দিয়েছে। বৈঠকে অংশ নেওয়া দলগুলো ভারতের উসকানি ও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ অবস্থান গ্রহণ করেছে। পাশাপাশি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে দেশজুড়ে সচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

সংলাপের শেষে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস বলেন, “আমাদের ঐক্যই আমাদের শক্তি। স্বাধীনতা রক্ষা ও দেশের উন্নয়নের জন্য আমরা সবাই একসঙ্গে কাজ করব।” আগামীতে ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে সংলাপের মাধ্যমে এই জাতীয় ঐক্যের ভিত্তি আরও মজবুত করার পরিকল্পনার কথাও জানান তিনি।

নিউজ ডেস্ক

প্রভাত সময় ২৪