• 23 Jan, 2025

নওগাঁয় শীতের সকালে খেজুর রসের স্বাদ

নওগাঁয় শীতের সকালে খেজুর রসের স্বাদ

শীতের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে নওগাঁর বিভিন্ন এলাকায় খেজুরগাছ থেকে রস সংগ্রহ শুরু করেছেন গাছিরা। রানীনগর থেকে আত্রাই পর্যন্ত শত শত গাছ থেকে সংগ্রহ করা হচ্ছে খেজুর রস, যা দিয়ে তৈরি হচ্ছে গুড় ও পাটালি। শীতের মিষ্টি রসের এই ঐতিহ্য স্থানীয় মানুষের কাছে অত্যন্ত প্রিয় হলেও গাছের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে।

শীতকাল এলেই আমাদের গ্রামীণ জীবনে ফিরে আসে এক স্বাদু ঐতিহ্য—খেজুরের রস। শীতের সকালে খেজুর রস পানের স্মৃতি বহুদিনের। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে গুড়, পাটালি এবং পিঠা-পায়েসের মিষ্টি অভিজ্ঞতা। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো নওগাঁ জেলাতেও শীতের আগমনে খেজুর রস সংগ্রহের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। গাছিরা ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন গাছের নলি লাগানো ও রস সংগ্রহে। নওগাঁর রানীনগর থেকে আত্রাই পর্যন্ত রেললাইনের দুই পাশে এবং নওগাঁ-নাটোর সড়কের দুই পাশে প্রায় ১৫ কিলোমিটারজুড়ে দেখা যায় অসংখ্য খেজুরগাছ। এই অঞ্চলে শীতের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে গাছিরা ব্যস্ত হয়ে ওঠেন গাছ কাটার কাজে। গতকাল শুক্রবার বিকেলে রেললাইনের পাশে কয়েকজন গাছিকে দেখা যায় খেজুরগাছে নলি লাগানোর কাজে। গাছিরা জানান, শীতের শুরুর দিকে রস কম হলেও শীত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রসের পরিমাণ বাড়ে এবং তা আরও মিষ্টি হয়ে ওঠে। নলডাঙ্গা থেকে আসা গাছি সাইফুল বলেন, ‘‘শীতের মৌসুমে খেজুরগাছ থেকে রস সংগ্রহ করে গুড় বানাই। আবার স্থানীয় লোকজন গাছতলা থেকেই রস কিনে নিয়ে যায়।’’ 

গাছিরা প্রথমে গাছের উপরিভাগে নির্দিষ্ট অংশে চাঁছ দিয়ে রাখেন। কয়েকদিন পর সেখানে নলি লাগানো হয়। এই নলি দিয়ে রস মাটির হাঁড়িতে ঝরে পড়ে। পরদিন সকালে গাছিরা এই হাঁড়ি নামিয়ে আনেন। সাইফুল আরও জানান, তিনি এবং তার সঙ্গীরা রেলওয়ের জমির খেজুরগাছ ইজারা নিয়ে কাজ করেন। এই বছর ১৬০টি গাছ ইজারা নিয়েছেন তাঁরা। নওগাঁর আরেক গাছি সন্তোষ কুমার বলেন, ‘‘প্রায় ৩০ বছর ধরে আমি এই কাজ করছি। এবার ২০টি গাছের মধ্যে পাঁচটি নিজের, আর বাকি ১৫টি গাছ লিজ নিয়েছি। রস সংগ্রহ থেকে খুব বেশি লাভ না হলেও এটি মৌসুমি আয়ের একটি মাধ্যম।’’ 

অতীতে যেসব জায়গায় প্রচুর খেজুরগাছ ছিল, সেখানে এখন গাছের সংখ্যা অনেক কমে গেছে। গাছ কেটে ফেলা এবং নতুন করে গাছ না লাগানোর প্রবণতায় এই ঐতিহ্য হুমকির মুখে। আত্রাইয়ের গাছি ছাবের দেওয়ান বলেন, ‘‘আগে আমাদের গ্রামে অনেক খেজুরগাছ ছিল। কিন্তু এখন অনেকেই গাছ কেটে ফেলেছেন। নতুন করে গাছ লাগানো হচ্ছে না।’’ 

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আবু কালাম আজাদ বলেন, ‘‘খেজুর রস সংগ্রহে কিছু সতর্কতা মেনে চলতে হবে। বিশেষ করে রস সংগ্রহের হাঁড়ি নেট দিয়ে ঢেকে দিতে হবে, যাতে বাদুড় বা পাখি রসে মুখ দিতে না পারে। এতে নিপাহ ভাইরাসের ঝুঁকি কমে।’’ তিনি আরও জানান, নওগাঁ জেলায় বর্তমানে ১৫০ হেক্টর জমিতে খেজুরগাছ রয়েছে। এ বছর খেজুরগাছ থেকে প্রায় ৮৫০ মেট্রিক টন গুড় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। 

শীতের সকাল মানেই খেজুর রসের মিষ্টি স্বাদ। এটি শুধু একটি পণ্যের উৎস নয়, বরং গ্রামীণ জীবনের ঐতিহ্যবাহী অংশ। খেজুরগাছ টিকিয়ে রাখতে এবং রস সংগ্রহের এই প্রাচীন পদ্ধতিকে ধরে রাখতে স্থানীয় প্রশাসন ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরকে আরও কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। এ ঐতিহ্য রক্ষা করা কেবল গাছিদের জন্যই নয়, বরং সমগ্র গ্রামীণ সংস্কৃতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নওগাঁসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শীতের সকালে খেজুর রসের স্বাদ উপভোগ করার এই ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে এবং এটি আরও বিস্তৃত করতে প্রয়োজন আমাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ। এই প্রাকৃতিক সম্পদকে সংরক্ষণ এবং সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারলে এটি হবে শীতকালের এক অনন্য আনন্দের উৎস।

নিউজ ডেস্ক

প্রভাত সময় ২৪